নির্দেশনা উপেক্ষা করে সব এলাকায় খুলেছে গার্মেন্টস

দেশে করোনা ভাইরাস থেকে সৃষ্টি হওয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সতর্কতার সঙ্গে শুরুতে দূরবর্তী শ্রমিকদের না এনে স্বল্প পরিসরে গার্মেন্টস কারখানা চালুর নির্দেশনা ছিল সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকেরাও জানিয়েছিলেন, শুরুতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ও নারায়ণগঞ্জের কিছু কারখানা চালু করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকার কারখানা খুলবে। তবে মালিকপক্ষ এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে দেশের প্রায় সব শিল্পাঞ্চলেই গতকাল কারখানা খুলে দিয়েছে। এই খবর শুনে চাকরি বাঁচাতে ফের ঢাকামুখী হয়েছেন গ্রামে যাওয়া শ্রমিকেরা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যে যেভাবে পারছেন, শিল্পাঞ্চলে ফিরছেন। ফলে বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল লকডাউন করে যে সুফল পাওয়া যাচ্ছিল, সেটি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই চাকরিচ্যুতি, পাওনা ও লে-অফ (সাময়িক বন্ধ) ইস্যুতে গতকাল দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রম অসন্তোষ হয়েছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশের হিসাবে, গতকাল গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জে অন্তত ২০টি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে রাজধানীতেও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে।

শ্রমিক নেতারা করোনা ভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের পরিস্থিতিতে কারখানা না খোলার পক্ষেই মত দিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, শ্রমঘন এ শিল্পে কারখানা চালু করার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি মানা সম্ভব হবে না। ফলে বড়ো ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।

স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে কেবল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কিছু কারখানা খোলার জন্য সদস্য কারখানা মালিকদের নির্দেশনা দিয়েছিলো তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এছাড়া শুরুতে সক্ষমতার ৩০ শতাংশ চালু করা এবং কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে—তাও জানিয়ে দিয়েছিল। ব্যতিক্রম হলে সংগঠন কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে পারবে না বলেও জানানো হয়। তা সত্ত্বেও ঢাকার বাইরে গাজীপুর, সাভার, চট্টগ্রামেও কারখানা খুলেছে। সে তুলনায় বরং ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস খোলার পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের অনুমতি নিয়েই (ঢাকার বাইরে অন্যান্য শিল্পাঞ্চলে) কারখানা খুলেছে। এসব কারখানা সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরেরও (ডিআইএফই) অনুমতি নিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে গতকাল খোলা কারখানার সংখ্যা খুবই কম এবং সীমিত পরিসরে কাজ করেছে। এ বিষয়ে জানতে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।

তবে শিল্পাঞ্চল পুলিশের তথ্য বলছে, গতকাল রাজধানীর বাইরে কারখানার খোলার পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ঢাকার বাইরেই ১ হাজার ৪২৭টি কারখানা খোলা হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা ৪৮০, বিকেএমইএর ১২১, বিটিএমএর ৫৮, বেপজার আওতাধীন ১৯৮ ও অন্যান্য খাতের ৫৭০টি কারখানা ছিল।

কারখানা খোলার ক্ষেত্রে বিজিএমইএ সদস্যদের যে গাইডলাইন দেয় তাতে বলা ছিল, কারখানা ভবনের বাইরে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা এবং কর্মীদের জুতায় জীবাণুনাশক স্প্রে করা বা জুতা পলিব্যাগে রেখে একটি নির্দিষ্ট স্থানে (সু র্যাক) রাখা, প্রবেশকালে তাপামাত্রা মাপা, কারখানার অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাজ করাসহ বেশকিছু নির্দেশনা ছিল। তবে শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক কারখানা এসব নিয়ম যথাযথভাবে মানেনি।

শ্রমিক নেতা ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রমিকদের কারখানায় আসার ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হচ্ছে না। এছাড়া পুরোদমে কারখানা চালু হলে এসব নিময় মানা আরো কঠিন হবে।

চাকরি বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি

গতকাল রবিবার থেকেই বিভিন্ন নৌরুটে শিল্পাঞ্চলমুখী মানুষের ঢল দেখা গেছে। এতদিন কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুট বন্ধ থাকলেও গতকাল থেকে সাতটি ফেরি চলাচল শুরু করেছে। যাত্রীরা জানায়, গার্মেন্টস খোলার কারণে চাকরি বাঁচাতে তারা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নিজ নিজ কর্মস্থলে ছুটছেন। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শিমুলিয়া ঘাট থেকে ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জে যেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন পালটে কর্মস্থলে ছুটছেন তারা। এদিকে, দিনের বেলায় দু-তিনটি ফেরি চললেও এখন রাতের বেলায় ছয়টি ফেরি চলাচল করছে। কারণ ফেরিতে পণ্যবাহী ট্রাক পার করা হচ্ছে। ‘গার্মেন্টস খুলবে’ এমন খবরে গতকাল কাঁঠালবাড়ী ঘাটে এসে ভিড় করে শ্রমিক-কর্মচারীরা। মহাসড়কে পরিবহন বন্ধ থাকায় ছোটো গাড়িতে ভেঙে ভেঙে তাদের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে এসে পৌঁছাতে হয়।

মোবাইল ফোনে এক শ্রমিক জানান, অনেক কষ্ট করে ঘাটে আসতে হয়েছে। যানবাহন না থাকায় ছোটো গাড়িতে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আসতে হয়েছে। মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সিরাজুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে শ্রমজীবী মানুষকে ফেরিতে নদী পার হতে দেখেছি। তিনটি ফেরিতে মানুষের চাপ বেশি ছিল। সব মিলিয়ে আনুমানিক দুই হাজার শ্রমজীবী মানুষ নদী পার হয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। কাঁঠালবাড়ী ঘাটে সেনাবাহিনী ও পুলিশ রয়েছে। তারা তাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ফেরিতে তুলে দিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।

তিনি আরো বলেন, শিমুলিয়া ঘাটে কোনো গণপরিবহন না থাকায় বিপাকে পড়েন শ্রমজীবীরা । বেশি ভাড়ায় তারা মিশুক ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন পিকআপ ভাড়া করে।