রাজনীতিতে নতুন মাত্রা
সম্প্রতি বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আলাপের একটি অডিও ফাঁস হয়। আবার কাছাকাছি সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই মোহতাশেম বাবর দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় আটক হয়েছেন। এই দুটি ঘটনার তদন্ত দাবি করে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) -এ অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল রাজধানী ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সোমবার (১২ এপ্রিল) অভিযোগপত্রসহ কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। এই সময়ে আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার ফাঁস হওয়া কথোপকথনের উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, “দুজনের কথোপকথনের মধ্য থেকে একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সেই বিষয়ের ব্যাপারে আমরা বলেছি, আপনারা (দুদক) তদন্ত জোরদার করুন। এ বিষয়ে শক্তিশালী তদন্ত করুন এবং আমরা সে–সংক্রান্ত কিছু দলিল, কাগজপত্র ওনাদের হাতে দিয়েছি, একটি পেনড্রাইভ দিয়েছি। সেই সঙ্গে কিছু ডকুমেন্টেশনও দিয়েছি।”
এছাড়া দ্বিতীয় অভিযোগ বিষয়ে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, “সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের ভাই ফরিদপুরের জনাব বাবর সাহেব (মোহতাশেম বাবর)। তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি, পরে কী হলো, কী কারণে এটি থেমে গেল বা সেই জায়গায় কী কাজ হচ্ছে, এ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ আছে। এই জিনিসের পরিষ্কার ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য আমরা এসেছি।”
এই সময়ে নিজ দলের নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির এই নেতা বলেন, “সেগুলো তো বিচারাধীন। যেগুলো বিচারাধীন নয়, আমরা সে ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে অপ্রমাণিত, সাজানো। আরেকটি হচ্ছে দুদক যদি স্বাধীনভাবে সেখানে কাজ করে, বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট দিতে পারে, সেখানে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই।”
দুদকে কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অপর রাজনৈতিক দলের এভাবে অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টিকে ‘নতুন মাত্রা’ বলছেন রাজনৈতিক নেতা ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে আলাপে তারা বলছেন এই ঘটনা রাজনীতিতে নতুন সংস্করণ।
অভিযোগকারী দল বিএনপির নেতারা বলছেন, এখন থেকে নিয়মিত তারা সরকারদলীয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে চান। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এই ঘটনা তারা দেশের জনসাধারণের সামনে বিবেচনার জন্য তুলে ধরবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ‘অনিয়ম ও লুটপাট ও দুর্নীতি’র বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্ন সময়ে কথা বলে এসেছি। এখন থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সরকারের সব ‘অনিয়ম ও লুটপাটে’র বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করবো। দুদক যেহেতু একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, তাই দুদকের মাধ্যমে এই অভিযোগ জমা দেওয়া হবে। সরকারের যদি সৎ সাহস থাকে তবে নিরপেক্ষভাবে এসব অভিযোগ তদন্ত করার ব্যবস্থা করা উচিৎ।”
ওদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ভয়েস অফ আমেরিককাকে বলেন, “বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আরেকটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্তের যে চিঠি দিয়েছে এটি আমি বলবো বিএনপির রাজনীতির একটি নতুন সংস্করণ। এখন এই অভিযোগ দেশবাসী কীভাবে গ্রহণ করে সেটাই দেখার বিষয়।”
অভিযোগ দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে, সেখানে দেশবাসীর করণীয় কেমন হতে পারে, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, “বিএনপির রাজনীতি হচ্ছে অভিযোগের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ একটি গণমানুষের দল। এই দলটি জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা পূরণে রাজনীতি করে থাকে। বিএনপি এখন গণতান্ত্রিক উপায়ে সফলতা না পেয়ে অভিযোগের রাজনীতিতে যাত্রা শুরু করেছে। দেখা যাক কী হয়।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ এখন ধীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। বিএনপি বিরোধী পক্ষ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে বিএনপি দুদকে চিঠি দিয়ে দিয়েছে, সেটি নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছে দেশে। সরকার দলকে মনে হয়েছে, এইসব অভিযোগ শুনে অভ্যস্থ। আর বিরোধীরা অভিযোগ জানিয়েই যাবে। কিন্তু, দুদকের কাছে অভিযোগ জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই অভিযোগের একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হল। এখন সরকার যদি নিরপেক্ষভাবে সহায়তা করে দুদককে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দেয়, তবে সেটি একটি নজির হবে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের সক্ষমতা নিয়ে যে প্রশ্ন দেখা যায়, সরকার দলের বিপক্ষে তাদের কোনো অবস্থান নেই, তারা কেবল সরকারের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করে এমন অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসার কাজটি দুদক শুরু করতে পারে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল মনে করেন বিএনপি যেহেতু এখন দুর্নীতির অভিযোগকারী দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে, ভবিষ্যতে দলটিকে এই বিষয়ে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হতে হবে। ভয়েস অফ আমেরিকাকে আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “বিএনপি যে বিষয়ে দুদকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছে, অভিযোগের তদন্ত দাবি করেছে সেটি নিয়ে দুদকের নিজ উদ্যোগেই তদন্ত করা উচিৎ ছিল বলে আমি মনে করি। যেখানে আইনমন্ত্রী নিজেও কথপোকথনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন সেখানে কেন দুদক এগিয়ে এলো না তদন্ত করতে! কিন্তু আমরা দেখছি যে, দুদক এখানে সবসময় সরকারের হয়ে বিরোধী দল বা বিরোধী মতের মানুষকে চাপে রাখতে কাজ করে। এখানে দুদক যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতো তাহলে এইসব অনিয়ম ও দুনীতি অনেকাংশে কমে আসতো।এখন বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল যারা আরেকটি দলের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে, এটাকে আমি মনে করি দুদকের অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিৎ। দেশের মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের নিরপেক্ষতা প্রমাণের এই সুযোগটি দুদকের নেওয়া উচিৎ।”
ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “একটি রাজনৈতিক দল আরেকটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্তে দুদকের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছে। এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এখন বর্তমান সরকার দেশে একটি বিচারব্যবস্থা চালু রেখেছে, ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা আছে। আস্থা আছে বলেই বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগপত্র জমা দিতে পেরেছে। ২০০৪ সালে ২১-এ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা থানায় বা বিভিন্ন সংস্থার অফিসে গিয়েও কোনো মামলা দিতে পারেনি। অভিযোগ জানাতে পারেনি। সেই বিবেচনায় হত্যার চেয়ে দুর্নীতি বড় অভিযোগ বলে মনে করি না। বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবেই বিচেনায় এনে বিচার করতে হবে।”