অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই চ্যালেঞ্জ, বাজেট আজ
করোনাকালের এ বিশেষ পরিস্থিতিতে একদিকে খাদ্য, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যয় বাড়ানোর চাপ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে যাওয়ায় আয়ের পথও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। স্থবির হয়ে যাওয়া ব্যবসাবাণিজ্যসহ অর্থনীতিকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অন্যদিকে আয় কমে যাওয়া বিশালসংখ্যক করদাতা এবং ভোক্তার ওপর করের চাপ কমানোর চাপও রয়েছে। এমন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আজ জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন ‘অর্থনৈতিক
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭২ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন। কালের পরিক্রমায় আসছে বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ৪৯ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সেইসাথে নিজস্ব অর্থের ব্যবহারে সক্ষমতাও বেড়েছে। কিন্তু সারা বিশ্বকে থামিয়ে দেওয়া করোনা ভাইরাসের এক ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপটে এবার বাজেট উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। বাজেট উপস্থাপনকালে বিদ্যমান বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে কীভাবে ‘জীবন ও জীবিকা’ রক্ষার মাধ্যমে অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে, তার বিবরণ দেবেন অর্থমন্ত্রী।
সাধারণ করদাতাদের কিছুটা ছাড় দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। অন্যদিকে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে থাকছে একগুচ্ছ পদক্ষেপ। তবে এর মধ্যেও বড়ো আকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে। বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে রাজস্ব কাঠামোর কিছু সংস্কার এবং আইনি জটিলতা কমনোর প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এতে স্বচ্ছতা আসবে। ফলে করদাতা ও ভোক্তার ওপর চাপ না বাড়িয়ে রাজস্বের বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাবে বলে মনে করছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা।
অর্থমন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বিদ্যমান আড়াই লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৩ লাখ টাকা হচ্ছে। এর পরবর্তী সময়ে ৩ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর থাকলেও এবার ৩ লাখ টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত একটি স্তর করা হচ্ছে। এই স্তরের করহার হচ্ছে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বশেষ স্তরে করের হার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে সব ধরনের করদাতারা ছাড় পাচ্ছেন। অন্যদিকে স্থানীয় শিল্প স্থাপনে উত্সাহ দেওয়ার লক্ষ্যে বেশকিছু খাতে আমদানি শুল্ক ছাড় কিংবা অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণাও থাকছে। নতুন করে সাতটি খাতে বিনিয়োগে কর অবকাশ সুবিধা আসছে। অপেক্ষাকৃত ছোটো ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে বিদ্যমান টার্নওভার ট্যাক্স কমানো হচ্ছে। বর্তমানে বছরে ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক বিক্রয়ের ওপর ৪ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স রয়েছে। এটি কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া আমদানিকালে পাঁচ শতাংশ আগাম কর বা এটির ক্ষেত্রেও ছাড় আসছে। বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ঠিক রেখে শিল্পের আমদানির ক্ষেত্রে তা কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা এবার শেয়ারবাজারসহ কয়েকটি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শেয়ারবাজারসহ মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিবেঞ্চার বা সরকারি কোনো সিকিউরিটি এক বছরের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। এ ব্যবস্থা বর্তমানেও রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে এই করের হার কমিয়ে দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে যেসব উদ্যোগ : এতসব ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলেও কর ও ভ্যাট ব্যবস্থাপনাকে রাজস্ববান্ধব করতে আইনে কিছু সংস্কার করা হচ্ছে। ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ও রেয়াত সংক্রান্ত ধারায় সংশোধন আসছে। অন্যদিকে মিথ্যা ঘোষণাসহ কিছু ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানের ঘোষণাও থাকছে। কোনো আমদানি কিংবা রপ্তানির ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা হলে ঐ পরিমাণ অর্থের ওপর ৫০ শতাংশ বাড়তি কর জরিমানা দিতে হবে। একইভাবে দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে ৫০ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে। রপ্তানির বিপরীতে উেস আদায় করা কর বিদ্যমান শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে শূন্য দশশিক ৫ শতাংশ হতে পারে। অবশ্য রপ্তানির ওপর উেস কর ১ শতাংশ রয়েছে। গত বছর রপ্তানিকারকদের লবিংয়ে তা এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা হয়। বহুল আলোচিত পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসতে পারে। বাড়তে পারে মোবাইল ফোন আমদানির শুল্কও। এতে স্থানীয় পেঁয়াজ উত্পাদনকারী কৃষক কিংবা স্থানীয় শিল্প কিছুটা সুরক্ষা পেলেও ভোক্তার ওপর চাপ বাড়তে পারে। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হতে পারে। চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা করা হলেও অর্থবছর শেষে তা ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরের জন্যও প্রায় ৫০ শতাংশ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য থাকছে। যদিও গত অর্থবছর স্বাভাবিক অর্থনৈতিক গতিতেও রাজস্ব আদায় বেড়েছিল মাত্র ১০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত পাচ্ছে বিশেষ গুরুত্ব : বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ওপর। পাশাপাশি করোনা থেকে উত্তরণের দিকনির্দেশনাও থাকবে বাজেটে। প্রান্তিক মানুষকে সহায়তা করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা আরো বাড়ানো হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে নানা উদ্যোগের ঘোষণা আসতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সংগত কারণেই এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কৃষি খাত, খাদ্য উত্পাদন ও ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে নানা ধরনের কৃষি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্যকে পুনরুদ্ধার করাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন প্রস্তাবনা থাকছে। এবারের বাজেট নথিও কমিয়ে আনা হচ্ছে। বাজেট বক্তৃতা, বাজেটের সংক্ষিপ্তসার, বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি, সম্পূরক আর্থিক বিবৃতি, মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে বাজেট ডকুমেন্ট।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী। এটি পাশ হবে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর। তবে গতকাল বুধবার থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় সংসদের অষ্টম অধিবেশন। চলতি একাদশ সংসদের দ্বিতীয় বাজেট অধিবেশন এটি। এবারের বাজেট অধিবেশনও গতানুগতিক হচ্ছে না। সীমিত ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক সংসদ সদস্য অধিবেশনে যোগ দেবেন। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর যেদিন যাদের বক্তব্য থাকবে, সেদিন শুধু ঐ সংসদ সদস্যরাই বৈঠকে থাকবেন। করোনার সংক্রমণ এড়াতে সংসদ কক্ষে সদস্যদের আসন বিন্যাসেও সাময়িক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সংসদ ভবনে এবার দর্শনার্থীর প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদেরও সংসদ ভবনে না গিয়ে সংসদ টিভি দেখে অধিবেশন কাভার করার অনুরোধ জানিয়েছে সংসদ সচিবালয়। অর্থমন্ত্রীর বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনও ভার্চুয়াল করা হবে বলে জানানো হয়েছে। Ittefaq